শনিবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৫

পাটখাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে আগে কৃষককে বাঁচাতে হবে - হারুন অর রশিদ


বিপ্লব কুমার দাস(শাওন)ঃ বর্তমানে পাটের বাজারের যে অবস্থা তাতে করে সরকার দ্রুত নানামুখী পদক্ষেপ না নিলে এ খাতকে টিকিয়ে রাখা মুসকিল হবে।

পাটখাতকে রক্ষা করতে হলে প্রথমেই কৃষককে বাঁচাতে হবে। যাদের ঘামে এবং শ্রমে পাট উৎপাদন হচ্ছে সেই কৃষকই এখন পাট চাষ করতে গিয়ে মরতে বসেছে। গ্রামে গঞ্জে এখন বলতে শোনা যায়- সোনালী আঁশ পাট এখন কৃষকের গলার ফাঁস। আমরা কৃষকদের এমন দুন্দশার কথা আর শুনতে চাইনা। পাট নিয়ে কোন রাজনীতিও আমরা দেখতে চাইনা।

সরকার, পাট ব্যবসায়ী এবং পাট চাষীদের সম্মিলিত উদ্যোগেই ‘সোনালী আঁশ পাট’ ফিরে পাক তার পুরনো গৌরব। এজন্য সরকারের সমন্বিত উদ্যোগই পারে এ খাতের পুরনো ইমেজ ফিরিয়ে আনতে। বর্তমান সরকার কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই নিয়েছে যা প্রসংসার দাবিদার। এ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী পাটখাতকে লাভজনক অবস্থায় নেবার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তবে পাট শিল্পকে রক্ষা করতে হলে সূদুর প্রসারী পদক্ষেপ নিয়ে সরকারকে আগাতে হবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ী ও পাট চাষী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক মোঃ হারুন অর রশিদ একান্ত এ সাক্ষাতকারে পাটের নানাদিক নিয়ে কথা বলেছেন। বর্তমানে সারাদেশে পাটের দাম নিম্মমুখী হচ্ছে বলে তিনি জানান।

হারুন অর রশিদ বলেন, একজন কৃষক যে অর্থ এবং শ্রম ব্যয় করে পাট উৎপাদন করছে সেই পাট বিক্রি করে লাভের মুখ দেখা তো দুরে থাক লোকসানের বোঝায় জর্জরিত হচ্ছে। ফলে এতদাঞ্চলের কৃষকেরা পাট আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। দিনে দিনে পাটের আবাদ আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে পাটের রাজধানী হিসাবে খ্যাত ফরিদপুর জেলায়। কৃষকদের পাট আবাদে উৎসাহী করতে তিনি কিছু পদক্ষেপ নেবার কথা বলেন। পাট আবাদে কৃষককে সুদমুক্ত ঋন দিতে হবে। উন্নতমানের বীজ সরবরাহ করতে হবে। সময় মতো সার, ডিজেল দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারী এবং বেসরকারী ব্যাংক গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সময়মতো বীজ, সার না পাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে কৃষকেরা পাট আবাদ করতে পারেন না। প্রয়োজনে সরকারের তরফ থেকে ন্যায্যমূল্যে বীজ ও সার দিতে হবে পাট আবাদকারী কৃষকদের। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে যারা কৃষি কর্মকর্তা আছে তাদের কৃষকদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। কৃষকদের পাট আবাদে নতুন নতুন জাত সর্ম্পকে পরামর্শ ও বুদ্ধি দিতে হবে। কৃষি কর্মকর্তাদের নজরদারী বাড়াতে হবে এবং পাট চাষীদের সাথে সুসর্ম্পক রাখতে হবে। তাছাড়া পাট আবাদকারী কৃষকদের মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে।হারুন অর রশিদ বলেন, বর্তমানে বাজারে উন্নতমানের পাট বিক্রি হচ্ছে ১২শ থেকে ১৪শ টাকায়। এ টাকায় পাট বিক্রি করে কৃষকদের পুঁজিই উঠছেনা। মন প্রতি কমপক্ষে ২৫শ টাকা দিলে কৃষকেরা বাঁচতে পারবে। বাজারে এখন যা দাম রয়েছে তা কৃষকদের জন্য কোন অবস্থাতেই তা সঠিক নয়। বর্তমানে বাজারে যে দামে পাট বিক্রি হচ্ছে- তাতে আগামী দিনে পাট আবাদ আশংকাজনক হারে কমবে।
তিনি বলেন- অনেক কৃষকই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, লাভ না হলে প্রতি বছর কেন তারা পাট আবাদ করবেন।পাটখাতকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আগে কৃষককে বাঁচাতে হবে বলে মনে করেন হারুন অর রশিদ।
সরকার যদি ন্যায্যমূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে পাট কিনতো তাহলে কৃষক হয়তো কিছুটা দাম পেতো।
কিন্তু সরকার কৃষকদের কাছ থেকে পাট কিনছেনা। আর কৃষকও সরকারের কাছে পাট বিক্রি করছেনা। তিনি বলেন, ফরিদপুরে সরকারী যে কয়টি পাটক্রয় কেন্দ্র রয়েছে সেখানে কৃষকেরা পাট বিক্রি করতে অনিহা দেখায়।

কেননা, সরকার নগদ টাকায় পাট কিনছেনা। অনেক সময় নগদ টাকায় পাট কিনলেও সেটি সময়মতো না কিনে দেরীতে কিনছে। ফলে সরকার যে দাম নির্ধারন করছে তা বাজার মূল্যের চেয়ে কম। ফলে সরকারী গুদাম গুলো এখনও ফাঁকাই রয়ে গেছে।

অন্যদিকে বিগত দিনে যেসব কৃষক বাকিতে সরকারী ক্রয় কেন্দ্র গুলোতে পাট বিক্রি করেছে সেই টাকাও তারা সময়মতো পাচ্ছেনা। যার কারনে কৃষকদের লোকসান হলেও নগদ টাকায় তারা ফড়িয়া কিংবা ব্যবসায়ীদের কাছে পাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও পাট চাষীরা সরকারের কাছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। প্রতি বছরই এ দেনা বাড়ছে। কিছু ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ী এখনো সরকারী গুদাম গুলোতে বাকিতে পাট বিক্রি করায় অল্প কিছু পাট গুদাম গুলোতে দেখা যাচ্ছে। ফরিদপুর জেলায় সরকারী ক্রয়কেন্দ্র গুলোতে পাট কেনার যে টার্গেট বেঁধে দেয়া হয়েছিল তার ২০ কিনতে পারেনি। তিনি মনে করেন, সরকারের কাছে কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের যে পাওনা রয়েছে তা দ্রুত পরিশোধ করলে কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সরকারী ক্রয়কেন্দ্র গুলোতে পাট বিক্রি করবে। পাট মৌসুমের শুরুতে সরকারী ক্রয়কেন্দ্র গুলোতে পাট কেনার জন্য টাকা না দেয়ায় নানা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন এর কর্মকর্তাদের উদাসিনতার জন্য পাটখাতে নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। পাট ক্রয়ের জন্য যে নীতিমালা রয়েছে তা মানা হচ্ছেনা বলে হারুন অর রশিদ মনে করেন।

তিনি বলেন, গত বছর পাটের যে দর নির্ধারন করে দেয়া হয়েছিল তা এখনো বলবৎ রয়েছে। কিন্তু বাজারে পাটের দাম বাড়ছে এবং অনেক সময় কমছে এগুলো মনিটরিং করা হচ্ছে না। ফলে পাটকল গুলো সঠিক দামে পাট কিনতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন ও পাট মন্ত্রনালয় যৌথ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পাটের বাজার পর্যবেক্ষন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, জেলা পর্যায়ে বিজেএমসি’র যে কেন্দ্র গুলো রয়েছে সেখানে একজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। যাতে করে তিনি সার্বক্ষনিক ভাবে বাজার মনিটরিং করতে পারে।

পাটখাতকে লাভজনক স্থানে নিতে হলে অবশ্যই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। পাটের উৎপাদিত বিভিন্ন পন্যের বাজার সৃষ্টি করতে হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনে পাটের সামগ্রী বিক্রির জন্য ঋন দিতে হবে। যারা পাট দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী উৎপাদন করবে তাদের সহায়তা দিতে হবে। এজন্য পাট মন্ত্রনালয়কে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে।
হারুন অর রশিদ বলেন, আমাদের পাট নিয়ে ভারত সহ বিভিন্ন দেশ নানা পণ্য তৈরী করছে। আর সে পণ্য আমরা কিনছি অধিক দামে। অনেক সময় আমাদের পাট ভারতে পাচার হয়ে যায়। এজন্য পাচার বন্ধে সরকারের নজরদারী বাড়াতে হবে।ফরিদপুর জেলার পাট বিশ্ব বিখ্যাত। এ জেলায় অন্যান্য ফসলের আবাদ বাড়ছে। অথচ বিরাট একটি সম্ভবনাময় খাত ‘পাট’কে অবহেলায় রাখা হচ্ছে।

তিনি সরকারের কাছে প্রস্তাব রেখে বলেন, পাটের রাজধানী খ্যাত ফরিদপুর জেলাকে নিয়ে একটি স্পেশাল প্রোগ্রাম হাতে নেয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ফরিদপুরের বিশাল একটি এলাকা নিয়ে ‘পাটজোন’ গড়ে তোলা যায়। অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি এ জোনে কৃষকেরা অগ্রাধিকার ভিক্তিতে পাট আবাদ করবে। সরকার তাদের সকল সুবিধা দেবে। এ জোন থেকে উৎপাদিত পাট কৃষকেরা নগদ মূল্যে সরকারী ক্রয় কেন্দ্র গুলোতে বিক্রি করবে। যদি এমনটি করা যায় তাহলে- পাট আবাদে এতদাঞ্চলের কৃষকেরা আগ্রহী হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ী ও পাট চাষী এসোসিয়েশন থেকে পাটখাতকে এগিয়ে নিতে কি কি উদ্যোগ এবং পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনটির সাধারন সম্পাদক বলেন, পাট ব্যবসায়ী ও পাট চাষীদের স্বার্থে আমাদের সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় পাটের ন্যার্যমূল্য দিতে সরকারকে চাপ দেয়া হচ্ছে। কৃষকদের পাট চাষে আগ্রহী করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। আমাদের সংগঠনটি বিভিন্ন সময় পাট মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে চাষী ও ব্যবসায়ীদের নানা দাবী পূরন করতে পেরেছি। সরকারের কাছে পাট ব্যবসায়ী ও কৃষকদের যে পাওনা রয়েছে তা পরিশোধ করতে আমাদের সংগঠনটি বড় একটি ভুমিকা রাখছে।
হারুন অর রশিদ মনে করেন বর্তমানে পাট মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে যে প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন তিনি একজন চৌকষ ব্যক্তি। ইতোমধ্যেই পাটখাতকে এগিয়ে নিতে এবং এ খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধে তিনি বেশ কঠোর ভুমিকা নিয়েছেন।
তার আশা সরকারের তরফ থেকে আরো কিছু সময়োপযুগী পদক্ষেপ নিলে পাটখাত তার হারানো গৌরব আবারো ফিরে পাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন