বিপ্লব কুমার দাস(শাওন)ঃ- ফরিদপুরের সালথা উপজেলার বল্লভদী ইউনিয়নের জবেদ শেখ ও রুকু শেখ হত্যা মামলার বেশীর ভাগ আসামীরাই রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ফলে মামলার বাদীকে প্রতিনিয়ত মামলা তুলে নিতে প্রাননাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। মামলার আসামীরা প্রভাবশালী হওয়ায় হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া দুটি পরিবারের স্বজনদের হুমকি-ধামকি দেবার পাশাপাশি গ্রাম ছাড়া করার কথাও বলা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ দিকে, সন্ত্রাসী হামলায় নিহত জবেদ আলী শেখ ও রুকু শেখের পরিবার দুটি তাদের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে একেবারেই নিঃস্ব হবার পথে। বর্তমানে দুটি পরিবারের মাঝে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। একদিকে হত্যাকারীদের নানা হুমকি-ধামকিতে নিরাপত্তাহীণতায় ভোগা এবং অন্যদিকে সংসার চালানো নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে দুটি পরিবারের স্বজনদের। ৭ সন্তান নিয়ে একেবারেই দিশেহারা হয়ে পড়েছে জবেদ শেখ ও রুকু শেখের স্ত্রী’রা। আত্বীয়-স্বজনদের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে কোন রকমে চলছে তাদের সংসার। খেয়ে না খেয়ে মানবেতরভাবে জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে তারা। জবেদ শেখ ও রুকু শেখের স্ত্রী-সন্তানেরা এমন নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচার দাবীর পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তার দাবী করেছেন প্রশাসনের কাছে। নির্মম-নৃশংস হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতার দাবীতে স্থানীয়রা সোচ্চার হলেও প্রভাবশালীদের ভয়ে অনেকেই প্রকাশ্যে কথা বলতে চাননি।
সরেজমিন ও স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে এবং মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, সালথা উপজেলার বল্লভদী ইউনিয়নের বাউসখালী গ্রামের আবেদ শেখ, জবেদ শেখ গংদের সাথে একই গ্রামের আতিয়ার ফকিরগংদের জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। এ বিরোধের জের ধরে মাঝে মধ্যেই তাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে গত ৫ মার্চ সকালে জবেদ আলী শেখ বাউসখালী বাজার থেকে বাড়ী ফেরার পথে আতিয়ার ফকির, বাচ্চু ফকির, জামাল শেখের নেতৃত্বে ২০/২৫ জনের একদল সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তার উপর হামলা চালায়। তারা জবেদ আলীকে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে আহত করে। জবেদ আলীর চিৎকার শুনে তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে রুকু শেক, ওহাব শেখ আইয়ুব, স্রাটসহ কয়েকজন তাদের উপরও হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এতে মারাত্বক ভাবে আহত হয় ঠেকাতে আসা লোকজন। সন্ত্রাসী হামলায় মারাত্বক ভাবে আহতদের পাশ্ববর্তী মুকসেদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে সেখানে মারা যায় জবেদ আলী শেখ। মারাত্বক আহত রুকু শেখকে মুকসেদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে সেখান থেকে তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরন করা হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় সেদিনই তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় রুকু শেখ।
দুটি হত্যাকান্ডের ঘটনায় আদালতে মামলা হয়। জবেদ আলী শেখ হত্যা মামলায় তার ভাই আবেদ শেখ বাদী হয়ে ১৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো ১০/১২ জনের নামে একটি মামলা করে। মামলার আসামীরা হলেন- মোঃ আতিয়ার ফকির, মোঃ জামাল শেখ, বাচ্চু ফকির, মোঃ চাঁন মিয়া, মোঃ তারা মিয়া, রাজিব শেখ, মোঃ সজীব শেখ, মোঃ জলিল শেখ, খলিল শেখ, নাজমুল শেখ, মোঃ ইমামুল শেখ, টুকু শেখ, জুয়েল ফকির, মোঃ হারুন খা, মোঃ বিপুল ফকির, শফিকুর রহমান মিলন, শাহজাহান মোল্যা ওরফে শাহান। নিহতের স্বজনেরা অভিযোগ করে বলেছেন, দুটি হত্যা মামলার বেশীর ভাগ আসামীরাই বর্তমানে ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
তাদের অভিযোগ, হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতরা স্থানীয় ভাবে বেশ ক্ষমতাশালী। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করছেনা। আসামীরা এলাকায় প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করলেও তাদের ধরতে পুলিশের অনিহা রয়েছে। নিহত জবেদ আলী শেখের ভাই আবেদ আলী শেখ অভিযোগ করে বলেন, আমার সামনেই সন্ত্রাসীরা আমার আপন ভাই জবেদ আলী ও চাচাতো ভাই রুকু শেখকে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে মারাত্বক ভাবে আহত করে। পরে তারা দুজনেই মারা যায়। আমাকেসহ আরো কয়েকজনকেও তারা কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে। ভাগ্য ভালা থাকায় এবং স্থানীয় বেশকিছু লোক ঘটনাস্থলে চলে আসায় আমরা প্রানে বেঁচে যাই।
তিনি অভিযোগ করে আরো বলেন, আসামীরা দিনের বেলা প্রকাশ্যে দুজনকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করেও এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। আমি মামলার বাদী হওয়ায় আমাকেও যে কোন সময় হত্যা করা হতে পারে। একাধিকবার আমাকে হত্যা করতে হুমকি দেয়া হয়েছে। মামলা তুলে না নিলে আমাকে করুন পরিনতি ভোগ করতে হবে বলেও হুমকি দেয়া হয়েছে। মামলা না তুললে আমাদের গ্রাম থেকেও উচ্ছেদ করা হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে। আমি আমার দু ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার চাই। বর্তমানে আমার পরিবারসহ আমার চাচাতো ভাইয়ের পরিবারের লোকজন চরম আতংকিত অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছি। একেকটি দিন যাচ্ছে আর মনে হচ্ছে আমরা এ হত্যাকান্ডের বিচার পাবোনা।
জবেদ শেখের স্ত্রী হাসিনা বেগম জানান, তার স্বামীর আয় দিয়েই সংসার চলতো তাদের। স্বামীকে হারিয়ে তিনি এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সংসার চালাতে গিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে হচ্ছে। চারটি মেয়ে নিয়ে তিনি এখন মানবেতরভাবে দিন কাটাচ্ছেন। তাছাড়া অব্যাহত হুমকির কারনে তিনি চার মেয়েকে নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানান।
নিহত রুকু শেখের স্ত্রী ফেরদৌসি আক্তার প্রশ্ন রেখে বলেন, প্রকাশ্যে যারা আমার স্বামীকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করলো, আমার তিন সন্তানকে যারা এতিম করলো তাদের বিচার কি কোনদিন হবেনা? যারা হত্যার সাথে জড়িত তারাই এখন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। নানাভাবে হুমকি দেয়। আমাদের গ্রাম ছাড়া করার কথা বলে, এদেশে কি আইন নেই। আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি চাই আমি।
ফেরদৌসি আক্তার বলেন, ছোট তিনটি ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। স্বামীর আয় দিয়েই চলতো গোটা পরিবার। স্বামী না থাকায় পুরো পরিবারটি এখন পথে বসার জোগার হয়েছে।নিহত জবেদ শেখের মা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘বাবারে আমার অনেক বয়স হইছে, আমি অহনো বাইচ্চা আছি। কিন্তু আমার পোলাডারে হেরা মাইরা হালাইলো। অহন আমাগো মাইরা হালানের কথা কয়। আমার পোলারে যারা মারছে, তাগো বিচার চাই আমি। আমি আমার পোলার খুনিগো ফাঁসি দেইখ্যা মরবার চাই’।
বাউসখালী বাজারের থাকা বেশ কয়েকজন ব্যক্তির সাথে হত্যাকান্ডের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তারা প্রথমে কেউই কথা বলতে চাননি। সাংবাদিক পরিচয় দিলে তাদের চোখে মুখে অজানা আতংকের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠে। নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দু একজনকে রাজী করানো গেলেও তারা বলেছেন, প্রভাবশালী একটি পরিবারের লোক এ হত্যাকান্ডের মামলার আসামী হওয়ায় এ নিয়ে কথা বলে তাদের শক্রু হতে চাইনা। তবে তারা একবাক্যেই বলেছেন, এ ধরনের ঘটনার সাথে জড়িতদের বিচার চান তারা। বাজার থেকে কিছুটা দুরে ইশারায় সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে যান জনৈক ব্যক্তি।
তিনি নামপ্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ বাজারে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে আসামী পক্ষেরও দু’একজন রয়েছে। যার কারনে তাদের উপস্থিতিতে কেউ হত্যাকান্ডের বিষয়ে মুখ খুলতে সাহস পাননি। তিনি বলেন, হত্যাকান্ডের কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও এখানে কোন সাংবাদিক আসতে সাহস পায়নি। প্রভাবশালী মহলটির ছত্রছায়ায় বেশকিছু ব্যক্তি পালাক্রমে বাজারে পাহাড়া দেয়। মূলত তাদের ভয়েই কেউ উচ্যবাচ্য করতে সাহস পায়না।