শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬

একজন আদর্শ মানুষ“কাঞ্চন মুন্সী”

মো. সেকেন্দার আলম ঃ-ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলার একজন আদর্শ মানুষের নাম “কাঞ্চন মুন্সী”। ফুল যেমন তার সৌন্দর্য, রং আর সূগন্ধে পরিপূর্ণতা পায় ঠিক তেমনি কামারগ্রাম পরিপূণর্তা পেয়েছে তার গুণে। তিনি সুদূর কলকাতা বসে কামারগ্রামবাসীর কথা ভাবতেন। কীভাবে এলাকার মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা যায়, এলাকার উন্নয়ন করা যায় তিনি এই চিন্তা করতেন। তিনি মানুষকে শুধু স্বপ্ন দেখাননি স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে যা যা করনীয় তা করেছেন। মানুষের পাশে থেকে তাদের দুঃখ কষ্টকে নিজের করে নিয়ে প্রমাণ করেছেন মানুষ মানুষের জন্য। তিনি উপজেলাধীন কামারগ্রামে জন্মেছিলেন বলেই পাশ্ববর্তী অনেক গ্রামের চেয়ে আগেই শিক্ষার আলো ও উন্নয়নের ছোঁয়া এখানে লেগেছিল। কাঞ্চন মুন্সী’র দরূন আজকের কামারগ্রাম গৌরবের সাথে মাথা উঁচু করে দাড়াতে সক্ষম হয়েছে।
বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক, জনদরদী মহান এ পুরুষ ১৮৮০ সালের ৫ই মে আলফাডাঙ্গা উপজেলার কামারগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ২০ বছর বয়সে কাঞ্চন মুন্সী কাজের সন্ধানে পাড়ি জমান কলকাতায়। কলকাতার পোর্ট শিপিং কোম্পানিতে প্রথম তিনি খালাসীর চাকুরী নেন। পরবর্তীতে তিনি এই পোর্ট শিপিং কোম্পানির ম্যানেজার হন। এই কোম্পানির আরো একটি শাখা এন্ডরোল কোম্পানি। এই এন্ডরোল কোম্পানিরও ম্যানেজার ছিলেন তিনি। কোম্পানিতে কর্মরত অবস্থায় তিনি বেতন পেতেন মাসিক ৫০০ টাকা। এন্ডরোল কোম্পানির ৯০০ ফ্লাট বোট ছিল ও ৪২ খানা তিনতলা জাহাজ ছিল। এই জাহাজ গুলির মালিক ছিলেন চার্লি কিংহাম এবং তার পুত্র কিংহাম এবং প্রধান ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন মিঃ হ্যাজমল। এই জাহাজ গুলি তখন বাংলা আসাম চলাচল করত। এসব জাহাজে কর্মরত ছিল ৩৫ হাজার শ্রমিক। এই ৩৫ হাজার শ্রমিকের বেতন নিতে হত কাঞ্চন মুন্সীর হাত থেকে। এ থেকে বোঝা যায় কতটা সৎ এবং নিষ্ঠাবান হলে এত বড় দায়িত্ব পাওয়া যায়। ইংরেজ সাহেবদের সাথে যোগাযোগ ঠিকমতো করার জন্য ইংরেজি ভাষা জানাটা খুব দরকার ছিল তাই কাঞ্চন মুন্সীর নিজের ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমে তা শিখে নেন। কঠোর পরিশ্রম ও চেষ্টার ফলেই তিনি হতে পেরেছিলেন ধনসম্পদের মালিক। এই ধন সম্পদের মালিক হয়ে মুন্সী সাহেব হয়ত নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারতেন কিন্তু সেটা তিনি করেননি। সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেছেন গ্রামের মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষের কল্যাণে।     কামারগ্রামের মানুষের সেবায় আমৃত্যু নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন কাঞ্চন মুন্সী। অত্র এলাকাকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কামারগ্রাম কাঞ্চন একাডেমী, যা এখনও আলফাডাঙ্গা উপজেলার স্বনামধন্য ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ। এ স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছেন এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই সরকারের সর্বোচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হয়েছেন। যা এই প্রতিষ্ঠানের জন্য গর্বেরও বটে। পাশাপাশি কামারগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাসপাতাল, মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ, জলদীঘি, কবরস্থান স্থাপনসহ তৎকালীন সময়ে তার জাহাজ কোম্পানিতে নিজ এলাকার প্রায় ১ হাজার মানুষকে কে চাকুরী দিয়ে বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করেছেন। আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে তিনি যদি এই অবদান না রাখতেন তাহলে কামারগ্রাম হয়তবা বাংলাদেশের আর দশটা অবহেলিত গ্রামের মতই থেকে যেত। কামারগ্রামে ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে দাড়িয়ে আছে মুন্সী বাড়ি। এই বাড়ির প্রতিটি ইট-পাথর আর চুন সুড়কীর গাঁয়ে জড়িয়ে আছে কাঞ্চন মুন্সীর স্মৃতি। বাংলা ১৩৩৭ সালে এক একর জমির উপর প্রতিষ্ঠা করেন এই কারুকর্যমন্ডিত দ্বিতল ভবন। এই বাড়িটির মিস্ত্রী ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ। মুন্সী বাড়ির আঙ্গিনায় রয়েছে মুন্সী বাড়ি মসজিদ ও পুকুর ঘাট। আর মুল ভবনের সাথে রয়েছে কাচারি ঘর। এই কাচারি ঘরে বসেই মুন্সী সাহেব এলাকার মানুষের সাথে বৈঠক করতেন। শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। কাঞ্চন মুন্সী কলকাতাতেই বেশি থাকতেন। তাই তাঁর জমিদারী তাঁর নায়েব গোমস্তারাই বেশি দেখাশোনা করতেন। বছরের বিভিন্ন সময়ে কলকাতা থেকে মধুমতি নদীর গোপালপুর ঘাটে এসে নামতেন তারপর পালকী অথবা ঘোড়া যোগে বাড়ি আসতেন। কাঞ্চন মুন্সী বাড়ি আসলে মুন্সী বাড়িতে জনসাধারণের ভিড় জমে যেত। কার কী প্রয়োজন সব তিনি শুনতেন আর চেষ্টা করতেন যতটা সম্ভব সাহায্য করার। কাঞ্চন মুন্সী নড়াইলের প্রভাবশালী জমিদার বনবিহারী বাবু এবং গিরিজাবালা সুন্দরীর নিকট থেকে জমিদারী পত্তনী পান।
 কাজের সুবাদেই কাঞ্চন মুন্সীকে কোলকাতা থাকতে হতো। কলকাতার মিশন রোডে মুন হাউস নামে পরিচিত ৭ তলা ভবন রয়েছে এছাড়াও কলকাতাতে আরও অনেক বাড়ি ছিল তাঁর। কলকাতার দম দম রোডের বাড়িতে তিনি স্থায়ী ভাবে বসবাস করতেন। এই বাড়িতে তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ আসতেন তাঁর সাথে দেখা করতে।
বাংলাদেশের খুলনা ও ঢাকাতে কাঞ্চন মুন্সীর বাড়ি রয়েছে। ঢাকার শ্রেষ্ঠ বাড়ি “রুপলাল হাউস” তিনি কিনেছিলেন। পরবর্তীতে বাড়িটি তাঁর মেয়েকে দান করে দেন। কাঞ্চন মুন্সী ১৯৪৮ সালে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা ছিল কামারগ্রামে থানা প্রতিষ্ঠা করবেন। এই লক্ষ্য বাস্তবাায়নে তিনি ঢাকা যান কিন্তু লক্ষ্য বাস্তবায়নের আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঢাকার রুপলাল হাউসে অবস্থানরত অবস্থায় ১৯৪৯ সালের ৪ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তাঁকে বিমান যোগে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায় শত শত মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে কলকাতার গোবরডাঙ্গা গোরস্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। কাঞ্চন মুন্সীর মতো সৎ ধর্মপ্রাণ মানুষ হয়ত আর ফিরে আসবেন না কামারগ্রামের মাটিতে। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট অবদানের দরূন মানুষের মধ্যে চিরঅমর হয়ে থাকবেন আজীবন। বর্তমানে কাঞ্চন মুন্সীর নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে “কাঞ্চন মুন্সী ফাউন্ডেশন” এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতি বছর কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন